ভবিষ্যৎ মহামারি আরো ভয়াবহ হতে পারে

প্রবন্ধ | মঈনউদ্দিন মুনশী

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান সম্প্রতি বিশ্বের সব দেশকে আগামী সম্ভাব্য মহামারির জন্য প্রস্তুত হতে বলেছেন। তিনি এই বলে সাবধান করেছেন যে ভবিষ্যৎ মহামারিজনিত স্বাস্থ্য সংকট কভিডের চেয়েও আরো ভয়াবহ হতে পারে। বিশ্বব্যাপী কভিডজনিত জরুরি অবস্থার সমাপ্তি ঘোষণার অব্যবহিত পরই এই সতর্কবাণী উচ্চারিত হলো, যদিও কভিডকে এখনো ভয়ের কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ নতুন নতুন ভেরিয়েন্ট দিয়ে এই অসুখ কোনো কোনো দেশে বেড়ে চলেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে এ পর্যন্ত প্রায় সাত কোটি মানুষ কভিডজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেছে। চীনে বর্তমানে কভিড ভেরিয়েন্ট ঢইই দিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা গত এপ্রিল মাস থেকে বেড়ে চলেছে। মে মাসের শেষে প্রদত্ত বিবৃতিতে চীনের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন যে জুন মাসের শেষ নাগাদ কভিড রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দেশব্যাপী সপ্তাহে সাড়ে ছয় কোটি হতে পারে। চীনে কভিড রোগ বৃদ্ধিতে আশঙ্কা করা হয় যে আরো ভয়াবহ ভেরিয়েন্টের উৎপত্তি হতে পারে।কভিড বিশ্বকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে আচমকা একটি মহামারি কিভাবে সব কিছু গ্রাস করে ফেলতে পারে। তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে এই ভাইরাস বিশ্বকে আক্রান্ত করে রেখেছে। ছোট আকারে হলেও এখনো এর সংক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। এই মহামারির ব্যাপক ধ্বংস সাধন মানুষকে সজাগ করেছে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য মহামারির বিষয়ে।কভিড মহামারির অভিজ্ঞতা থেকে এটি বোঝা গেছে যে পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষ যাতে এ ধরনের সব অসুখ থেকে আরো ভালোভাবে রক্ষা পেতে পারে সে ব্যবস্থা এখনই নেওয়া প্রয়োজন।

বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১৯৪টি সদস্য দেশ ‘মহামারি সমন্বয় কমিটি’তে কাজ করছে। বিশ্বকে আরো নিরাপদ করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রয়োজন। কভিডের সময় আতঙ্ক ও উপেক্ষার চক্র পৃথিবীকে যে রকম অসহায় করে ফেলেছিল, সে ধরনের অবস্থা যাতে আর না হয় সেই লক্ষ্যে এই কমিটি কাজ করছে।

বিশ্বে ১৯০০ সাল থেকে পাঁচটি মহামারি ঘটেছে, সেগুলো হয় ইনফ্লুয়েঞ্জা অথবা করোনাভাইরাসজনিত।

২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা ৯০০-র বেশি সংক্রামক ভাইরাস আবিষ্কার করেছেন। গবেষণায় জানা গেছে, প্রায় ২৬টি ভাইরাস মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে। এগুলোর উৎপত্তি প্রধানত বাদুড় এবং অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণী থেকে। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে মানুষ এবং এ ধরনের প্রাণীর সংমিশ্রণের ফলে ভয়াবহ সব সংক্রামক ভাইরাস সৃষ্টি হয়ে মহামারির সূচনা করতে পারে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং প্রকৃতির মধ্যে অসামঞ্জস্যের কারণে প্রায় ১০০ কোটিরও বেশি মানুষ বিপদের ঝুঁকিতে রয়েছে। পশ্চিম আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু অংশে অনেক মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাস করে, যারা ওই সব প্রাণী থেকে সংক্রমিত হতে পারে। এসব এলাকা থেকে মহামারি শুরু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকায় করোনাভাইরাস ও ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস ছাড়াও কিছু জীবাণুর উল্লেখ আছে, যেগুলোর মহামারি সাধন করার সম্ভাব্য শক্তি রয়েছে; যেমন—ইবোলা (Ebola), মারবার্গ (Marburg), লাসা (Lassa fever), নিপাহ (Nipah),জিকা (Zika), হেমোরেজিক ফিভার (Haemorrhagic fever) ভাইরাস ইত্যাদি। ভবিষ্যৎ মহামারির আলোচনায় সম্ভাব্য জীবাণুগুলোর বৃত্তান্ত কিছুটা জানা প্রয়োজন।

ডিজিজ এক্স (Disease X) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ রোগের তালিকায় রয়েছে এই সম্ভাব্য অসুখের আশঙ্কা। অসুখটি এখনো সম্পূর্ণ অজানা, যেটি হঠাৎ যেকোনো সময় শুরু হয়ে যেতে পারে এবং যেটি খুবই সংক্রামক ও ভয়াবহ হতে পারে। কভিড মহামারি থেকে আমরা বুঝেছি যে সংক্রামক ভাইরাসজনিত অসুখ যেকোনো সময় আবির্ভূত হয়ে বিশ্বকে আলোড়িত করতে পারে এবং মানুষ জাতিকে বাধ্য করতে পারে এর সঙ্গে সহাবস্থানের উপায় উদ্ভাবন করতে। যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক গ্লোবাল হেলথ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. জনাথন কুইক বলেছেন আরএনএ (জঘঅ) ভাইরাসকে সম্ভাব্য মহামারির জীবাণু হিসেবে গণ্য করতে। কারণ এই ভাইরাসের জিনে ভালো স্বয়ং সংশোধন ব্যবস্থা নেই এবং সে জন্য সহজেই জিন মিউটেশন ঘটে। আরএনএ ভাইরাসগুলোর মধ্যে করোনাভাইরাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং এইচআইভি ভাইরাস অন্যতম।

ইবোলা (Ebola) এটি সবচেয়ে ভয়াবহ সংক্রামক অসুখ। সম্প্রতি ২০২২ সালে এর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে আফ্রিকা মহাদেশে। ২০১৪ সালে এই অসুখ পশ্চিম আফ্রিকায় শুরু হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল অনেক দেশে। তখন মহামারির আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। তখন এর ভ্যাকসিন তৈরি হয়, যেটি এর দুটি ভ্যারাইটির মধ্যে শুধু একটির বিপক্ষে কার্যকর। বাদুড় এই ভাইরাস বহন করে। এই অসুখ আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত, কফ, বীর্য, মল, মূত্র ইত্যাদির সংস্পর্শ থেকে অন্য মানুষে ছড়িয়ে যেতে পারে। মৃত ব্যক্তিও ছোঁয়াচে। তাই মৃতের সৎকার সাবধানে করা প্রয়োজন। এই রোগের ভয়াবহতা ২৫ থেকে ৯০ শতাংশ। হাসপাতাল বা নার্সিং হোমে যদি যথাযথ জীবাণু প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয়, তাহলে খুব দ্রুত এই রোগ ছড়াতে পারে।

নিপাহ (Nipah) বাংলাদেশ ও ভারতে প্রায় প্রতিবছরই বেশ কিছু সংখ্যক মানুষ এতে আক্রান্ত হচ্ছে। এ বছরের (২০২৩) জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে এই অসুখে আটজন মৃত্যুবরণ করেছে। সাধারণত এই অসুখে লঘু উপসর্গ হয়, তবে কিছু রোগীর স্নায়ুতন্ত্রের প্রদাহ ঘটেছে বলে জানা গেছে। মৃত্যুহার ৪০ থেকে ৭০ শতাংশ। বাদুড়, শিয়াল, শূকর, ঘোড়া, বিড়াল ও কুকুর এই ভাইরাস বহন করতে পারে। অসুস্থ পশুর সংস্পর্শে এসে অথবা কলুষিত খাবার খেয়ে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। এই অসুখের কোনো ভ্যাকসিন অথবা চিকিৎসা এখন পর্যন্ত নেই।

জিকা (Zika) ২০১৫-১৬ সালে এই রোগ আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। ব্রাজিলে এর প্রাদুর্ভাব ঘটার পর দক্ষিণ আমেরিকার সব দেশে এটি ছড়িয়ে পড়েছিল। মশার কামড়ে এই রোগের সংক্রমণ ঘটে। সাধারণত জ্বর ও চামড়ায় ফুসকুড়ির সৃষ্টি করে। তবে দেখা গেছে, আক্রান্ত কিছু শিশুর মাথার আয়তন ছোট হয়েছে এবং কারো স্নায়ুতন্ত্রের অসুখ হয়েছে। ২০১৬ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই অসুখকে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এযাবৎ ৮৬টি দেশে এই রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে পৃথককরণ ও মশা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এ পর্যন্ত এই রোগের কোনো ভ্যাকসিন নেই।

হেমোরেজিক ফিভার (Haemorrhagic fever) এই ভয়াবহ অসুখ বেশ কয়েকটি ভাইরাস দিয়ে হতে পারে; যেমন—মারবার্গ ভাইরাস, যেটি ইবোলার মতো, লাসা ফিভার ভাইরাস প্রধানত লাইবেরিয়া ও সিয়েরা লিওনে পাওয়া যায়, রিফট ভ্যালি ফিভার ও ক্রাইমিয়া কঙ্গো হেমোরেজিক ফিভার ভাইরাস আফ্রিকা এবং এশিয়া।


লেখক:

মঈনউদ্দিন মুনশী

মঈনউদ্দিন মুনশী

মেডিক্যাল ডিরেক্টর, সংক্রামক ব্যাধি বিভাগ, সুমা হেলথ সিস্টেম, বারবারটন, ওহাইও, যুক্তরাষ্ট্র। ফেলো, আমেরিকান কলেজ অব ফিজিশিয়ান্স ও সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ সমিতি। সহযোগী অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, নর্থ ইস্ট ওহাইও মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র

Pin It on Pinterest

Share This